Thise-is-isalm |
উছিলা বা ওয়াসীলাহ কী ও এর প্রকারভেদ এবং ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ(জায়েজ) বা অবৈধ(নাজায়েজ) উছিলার ব্যাখ্যাসহ বিস্তারিত বিবরণ
আমাদের উপমহাদেশে উছিলা শব্দটি খুবই পরিচিত। সাধারণত আমরা উছিলা বলতে কারো দ্বারা বা কারো মাধ্যমে কিছু পাওয়াকে বুঝি। যেমনঃ অমুকের উছিলায় আমি এটা পেয়েছি বা করেছি। এই উছিলা বলতে সাধারণত ব্যক্তিকে মাধ্যম বিবেচনা করা হয়। কিন্তু আরবি শব্দ হচ্ছে ওয়াসীলাহ্ (وسيله)। যা ইসলামী পরিভাষায় অন্য ধরনের ব্যাখ্যা হয়।
ওয়াসীলাহ্ঃ
ওয়াসীলাহ্ (وسيله) আরবি শব্দ। এর অর্থ উপায়, উপকরণ, নৈকট্য, মর্যাদা, অবস্থান, ব্যবস্থা, মাধ্যম যা দ্বারা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছা যায়। আরেকটি অর্থ হয় শাসকের নিকট সম্মান, মর্যাদা এবং নৈকট্য লাভ।
ইসলামী পরিভাষায় এর অর্থ হলো আল্লাহর কাছে নৈকট্য বা সন্তুষ্টির জন্য এমন কোনো পন্থা, উপায় বা পথ অবলম্বন করা। যা দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং নৈকট্য লাভ করা যায়।
যেমনঃ বিভিন্ন ধরনের শরীয়তসম্মত ইবাদত যা আল্লাহর নিকট পছন্দনীয় এবং রাসুলুল্লাহ কতৃক অনুমোদিত। সোজা কথায় ইবাদত বন্দেগী, দান, সদকা, জিহাদ, লোভ, পাপ, কাম, ক্রোধ থেকে বেচেঁ থাকার ধৈর্য্য ইত্যাদি সবই হচ্ছে আল্লাহর নিকট পছন্দনীয় হওয়ার উপায়।
উছিলা দুই প্রকারঃ-
১) বৈধ উছিলা বা শরীয়তসম্মত উছিলা।
২) অবৈধ উছিলা বা শরীয়ত নিষিদ্ধ উছিলা।
শরীয়তসম্মত উছিলা কীঃ
শরীয়তসম্মত উছিলা হলো এমন সব ওয়াজিব, মুস্তাহাব, নফল ইবাদত যা দ্বারা আল্লাহ্ সন্তুষ্ট হয়। ঐ ইবাদত হোক মৌখিক, হোক কর্মের দ্বারা অথবা হোক তা বিশ্বাসগত।
শরীয়তসম্মত উছিলাকে তিন ভাগে ভাগ করতে পারিঃ
১) আল্লাহর নাম দিয়ে তাকে ডাকাঃ
বান্দার জন্য সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য উছিলা হলো আল্লাহর নাম এবং তাঁর গুণাবলী দিয়ে উছিলা করা। অর্থাৎ আল্লাহর নাম দিয়ে তাঁর কাছে চাওয়া।
আল্লাহ্ বলেন,
” আর আল্লাহর জন্যই রয়েছে সুন্দরতম নামসমূহ। সুতরাং তোমরা তাঁকে সেসব নামেই ডাক।” আল আরাফ [৭:১৮০]
অর্থাৎ আল্লাহর রয়েছে সুন্দর সুন্দর নাম। সুতরাং হে বান্দারা তোমরা তাঁকে তাঁর সুন্দর নামের উছিলা দিয়েই ডাকো।অতএব, আল্লাহর সুন্দর নামের উছিলা দিয়েই আল্লাহ্কে ডাকতে হবে এবং ডাকা উচিত। আর এটাই আল্লাহ্কে ডাকার সঠিক পদ্ধতি। যা আল্লাহ্ নিজেই শিক্ষা দিচ্ছেন।
২) বান্দার নেক আমলের উছিলা দিয়ে আল্লাহ্কে ডাকাঃ
যিনি আল্লাহর কাছে দোয়া চাইবেন তিনি এমন ভাবে প্রার্থনা করতে পারেন যে, হে আল্লাহ্ আপনার প্রতি ঈমান, আমল, ভালোবাসার এবং আপনার রাসুলের প্রতি ঈমান ও ভালোবাসার উছিলায় আমার অমুক অমুক নেক আমলের উছিলায় আমার প্রার্থনা কবুল করুন।
এমন সব আমলের কথা উছিলা করতে হবে যা শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা হয়েছে। হতে পারে আল্লাহর প্রতি ঈমান, সালাত, সিয়াম, হজ্জ, যাকাত, দান, সদকা, জিহাদ, দ্বীনের দাওআত ইত্যাদি। যেভাবে আল্লাহর কাছে দোয়া চাওয়া যায়। এ বিষয়ে আল্লাহ্ বলেন,
” যারা বলে, ‘হে আমাদের রব, নিশ্চয় আমরা ঈমান আনলাম। অতএব, আমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করুন এবং আমাদেরকে আগুনের আযাব থেকে রক্ষা করুন”। [আল ইমরান৩:১৬]
পবিত্র হাদীসেও এসেছে পূর্বযুগে বিপদে পতিত লোকেরা তাদের নেক আমলের উছিলা দ্বারা আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতো। আল্লাহও তাদের দোয়া কবুল করতো।
৩) জীবিত নেককার ব্যক্তির উছিলায় দোয়া করাঃ
যদি কেউ নিজের আমলের দূর্বলতার কারণে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতে শর্মিন্দা হয় বা নিজের উপর ভরসা না থেকে । তবে কোনো পরহেজগার বুজুর্গ ব্যক্তি যার কাছে কুরআন হাদিসের জ্ঞান ও আমল আছে তার কাছে গিয়ে নিজের সমস্যার জন্য তার উছিলায় দোয়া করা।
এটিও শরীয়তসম্মত যে, কোনো এলেমদার আবেদী বান্দার উছিলায় দোয়া করা বা তার পক্ষ থেকে আল্লাহর কাছে দোয়া চাওয়া যায় এবং জায়েজ।
আল্লাহ্ বলেন,
” যারা তাদের পরে এসেছে তারা বলে: ‘হে আমাদের রব, আমাদেরকে ও আমাদের ভাই যারা ঈমান নিয়ে আমাদের পূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে তাদেরকে ক্ষমা করুন; এবং যারা ঈমান এনেছিল তাদের জন্য আমাদের অন্তরে কোন বিদ্বেষ রাখবেন না; হে আমাদের রব, নিশ্চয় আপনি দয়াবান, পরম দয়ালু। [ আল হাশ্র। ৫৯:১০]
হাদীসে এসেছে কোনো মুমিন ভাই তার অপর মুমিন ভাহয়ের জন্য দোয়া করলে তা আল্লাহ্ কবুল করেন। (সহীহ্ মুসলিম ২৭৩৩)
একদা উমর রাঃ এর জমানায় মদিনায় দূর্ভিক্ষ দেখা দিলে তিনি রাসুলুল্লাহ সাঃএর চাচা আব্বাস রাঃ কে উছিলা দিয়ে দোয়া করিছিলেন। এবং বৃষ্টিও হয়েছিল। (সহীহ্ মুসলিম)
সুতরাং জীবিত নেককার অলি বুজুর্গ ইত্যাদির উছিলায় দোয়া বা সাহায্য চাওয়া জায়েজ।
শরীয়ত বহির্ভূত বা নিষিদ্ধ উছিলাঃ-
১) কারো মর্যাদার উছিলা দেওয়াঃ
কারো মান সম্মান জশ খ্যাতি ইত্যাদি দিয়ে উছিলা করা শরীয়ত সম্মত নয়। হোক তিনি জীবিত কিংবা মৃত। অথবা মৃত কোনো বুজুর্গের নামের উছিলা দিয়েও দোয়া করা যাবে না। এই শিক্ষা কুরআন এবং সুন্নাহ বিরোধী।
রাসুল কখনোই এমন শিক্ষা দেন নাই যে কোনো নবী রাসুলের বা অলি আউলিয়ার মান মর্যাদার দোহাই বা উছিলা দিয়ে দোয়া বা প্রার্থনা করা যাবে। কেননা আল্লাহ্ খালেক আর নবী রাসুল ফিরিশতা অলি হচ্ছেন মাখলুক। আল্লাহ্ কারো উপর সন্তুষ্ট হতে যেমন মাধ্যম লাগে না। ঠিক তেমনি কারো উপর অসন্তুষ্ট হলে সেখানেও কেউ অন্তরায় হতে পারে না।
সেজন্য আল্লাহর রাসুলের ওফাতের পরে রাসুলের চাচাকে দিয়ে উছিলা করে দোয়া চাওয়া হয়েছে। অথচ রাসুলের সম্মানের উছিলায় নয়। সুতরাং কোনো মৃত অলি আউলিয়াকে উছিলা করা যাবে না।
যদি মৃত কাউকে উছিলা করা জায়েজ হতো তাহলে এই দুনিয়ায় একমাত্র উছিলা দেওয়া যেতো হযরত মুহাম্মদকে। এই পৃথিবীতে রাসুলের সাঃএর চাইতে উত্তম কেউ নেই। তবুও সাহাবাগন রাসুলের নাম উল্লেখ না করে জীবিত আব্বাস রাঃকে দিয়ে উছিলা করে দোয়া চেয়েছেন।
এইজন্যই মৃতকে উছিলা করা নিষিদ্ধ, কারণ এতে করে শির্কের উৎপত্তি হয়। মক্কার মুশিরকরাও মৃতকে উছিলা দিয়ে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতো।
পবিত্র কুরআনে এসেছে,
” জেনে রেখ, আল্লাহর জন্যই বিশুদ্ধ ইবাদাত-আনুগত্য। আর যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যদেরকে অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করে তারা বলে, ‘আমরা কেবল এজন্যই তাদের ‘ইবাদাত করি যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেবে।’ [ আয যুমার ৩৯:৩ ]
এই আয়াতে এটা সুস্পষ্ট যে, মুশরিকরা তাদের দেব দেবী অলিদের এইজন্য অভিভাবক মানতো উছিলা মানতো যাতে করে এই দেব দেবীরা আল্লাহর কাছে তাদেরকে নিকটবর্তী করে দেয় অর্থাৎ দোয়া প্রার্থনা কবুল করিয়ে নেয়। কিন্তু আল্লাহর কখনোই এটা পছন্দনীয় নয় যে তাঁর বান্দা শির্ক করবে। অতএব মৃত কাউকে দিয়ে উছিলা করা যাবে না।
২) জীবিত বা মৃত অলি আউলিয়ার নিকট সরাসরি চাওয়াঃ
বান্দার যেকোনো প্রয়োজনে মৃত অলি আউলিয়ার কাছে চাওয়া যাবে না। বলা যাবে না হে অমুক হে আমার বাবা, আমাকে উদ্ধার করো, আমাকে সাহায্য করো, তোমার মুরিদের এই দুঃখে তুমি সাড়া দাও ইত্যাদি ইত্যাদি। কেননা আল্লাহ্ ছাড়া অন্যের নিকট সাহায্য প্রার্থনা হচ্ছে শির্ক করা।
সেইসাথে কোনো বিপদ থেকে উদ্ধার হতে বা কোনো কাজ হাসিলের জন্য কোনো পীর আউলিয়ার দরবারে মান্নত করা যাবে না। মান্নতের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহর হুশিয়ারি রয়েছে। তিনি মান্নত করতে নিষেধ করেছেন।
পবিত্র হাদীসে এসেছে,
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘তোমরা মানত করবে না। কেননা মানত তাকদীরের কোনো কিছু-কে ফেরাতে পারে না। এটা শুধু কৃপণ থেকে সম্পদ খসায়।‘ (সহিহ বুখারি ও মুসলিম, হাদীস নং ৪৩২৯, সহিহ সুনান তিরমিজি, সহিহ সুনান নাসায়ি)
অন্য হাদীসে এসেছে,
সাহবি আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘যেই বস্তু মহান আল্লাহ আদম সন্তানের জন্য নির্ধারণ করেননি মানত সেটি তার নিকটবর্তী করে না। বরং তাকদীরে যা আছে মানত সেটাই নিয়ে আসে। এর মাধ্যমে কৃপণ ব্যক্তির সম্পদ বের করা হয় যা সে খরচ করতে চায়নি।‘ (সহিহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৩৩১)
উপরোক্ত হাদীসসহ আরো অসংখ্য হাদীসে মানতের বিরুদ্ধে রাসুলুল্লাহর হুশিয়ারি দিয়েছেন। এটা জানার পরও যদি কেউ পীর আউলিয়ার উছিলায় কোনো কিছু পাওয়ার জন্য মানত করে তাহলে তা সুস্পষ্ট রাসুলের আনীত দ্বীনের বিরোধী। যা শির্ক এবং তা করলে ঈমান নষ্ট হয়ে যাবে।
রাসুলুল্লাহ এবং তাঁর সাহাবীদের শিক্ষা হলো যেকোনো প্রয়োজনে যেকোনো সময় চাইতে হবে আল্লাহর কাছে। তিনিই আমাদের জন্য যথেষ্ট।
আল্লাহ্ বলেন,
” আর যখন আমার বান্দাগণ তোমাকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবে, আমি তো নিশ্চয় নিকটবর্তী। আমি আহবানকারীর ডাকে সাড়া দেই, যখন সে আমাকে ডাকে। সুতরাং তারা যেন আমার ডাকে সাড়া দেয় এবং আমার প্রতি ঈমান আনে। আশা করা যায় তারা সঠিক পথে চলবে”। [আল বাকারা ২:১৮৬]
এ থেকে সুস্পষ্ট যে আল্লাহ্ চাই তাঁর বান্দারা তাঁকে ডাকুক এবং তিনি তাদের ডাকে সাড়া দিবেন। শুধু তাই নয়, রাসুলুল্লাহ সাঃএর শিক্ষাও হচ্ছে “দোয়াই হচ্ছে ইবাদতের মূল ” (তিরমিযী) , সুতরাং কারো মাধ্যমে নয় আল্লাহর কাছে চাইতে হবে সরাসরি। যারাই আল্লাহর কাছে চাইবে তাদেরই আল্লাহ্ সাড়া দিবেন।
আল্লাহ্ তাঁর বান্দার শরীয়তসম্মত যেকোনো দোয়া ইবাদত কবুল করেন। কিন্তু শির্ক কখনোই ক্ষমা করেন না তওবা ছাড়া। আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো নিকট চাওয়া হচ্ছে সরাসরি শির্ক।
আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে বলে,
” নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শরীক করাকে ক্ষমা করেন না। তিনি ক্ষমা করেন এ ছাড়া অন্যান্য পাপ, যার জন্য তিনি চান। আর যে আল্লাহর সাথে শরীক করে সে অবশ্যই মহাপাপ রচনা করে।” (আন নিসা ৪ : ৪৮)
৩) অলি আউলিয়ার সন্তুষ্টির জন্য পশু জবাইঃ
কেউ যদি কোনো উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য অলি আউলিয়াকে উছিলা করে এবং পশু কুরবানীর মানত করে তাহলে তা হবে শির্ক। অলি আউলিয়ার উছিলায় পশু কুরবানি করা জায়েজ নয়। কেননা যেকোনো কিছু ভালো মন্দ করার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর। তাই কেউ যদি মানত করে তবে তা আল্লাহর নামে তাঁর রাস্তায় মানত করতে হবে (যদিও মানত নিষিদ্ধ)।একমাত্র আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে অন্য কারো সন্তুষ্টির জন্য কিছু করলেই তা হবে শির্ক। এব্যাপারে আল্লাহ্ বলেন,
” তোমরা ইবাদাত কর আল্লাহর, তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করো না। ( আন নিসা ৪: ৩৬ )
আল্লাহ্ আরো বলেন,
” জেনে শুনে কাউকেও আল্লাহর সমকক্ষ স্থির করো না।” (আল বাকারা : ২২)
সুতরাং কেউ যদি মনে করে তাকে আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কেউ তার ভালো, মন্দ, বিপদ থেকে উদ্ধার, সুস্থতা, সন্তান দান, জীবনে সফলতা ইত্যাদি দিতে তাহলে তা হবে শির্ক। এই ধরনের উছিলা কখনোই ইসলামী শরীয়তসম্মত নয়। এইধরণের কাজে ঈমান নষ্ট হয়ে যায়।
এই বিষয়ে অনেকেই যে ভুলটা করেন তা হচ্ছে, যারা অলি আউলিয়াদের দরবারে গরু ছাগল ইত্যাদি মানত করে সেখানে জবাই করে। তাদের দাবি তারা এইসব পশু জবাই করার সময় আল্লাহর নাম নিয়ে তবেই জবাই করা হয়। তাহলে এটা শির্ক কেন হবে?
এই প্রশ্নের উত্তরে তাদের যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, কেন তারা মৃত ব্যক্তির কবরে গিয়ে পশু জবাই করছে? তাহলে তার উত্তর হবে ঐ মৃত ব্যক্তির প্রতি সন্তুষ্টি, কৃতজ্ঞতা এবং ভালোবাসার কারণে। ঐ মৃতের প্রতি এই সন্তুষ্টি কৃতজ্ঞতা এবং ভালোবাসা কেন এসেছে? তার উত্তর হবে, ঐ বুজুর্গ ব্যক্তির উছিলায় তারা অমুক অমুক জিনিস লাভ করেছে। কিংবা অমুক অমুক বিপদ থেকে উদ্ধার হয়েছে। অথবা সন্তান ছিলো না এই বুজুর্গের উছিলায় সন্তান এসেছে ইত্যাদি ইত্যাদি দুনিয়াবী বিভিন্ন লাভের কথা চলে আসবে অটোমেটিকালি।
তাহলে এখন যদি বলি, যেসব কারণে ঐ বুজুর্গের ভক্তরা তার প্রতি সন্তুষ্ট। সেইসব কারণ কি (অর্থাৎ ঐসব উপকার) আসলেই ঐ বুজুর্গের কারণে হয়েছে? আসলেই কি এইসব করা ঐ মৃত বুজুর্গের ক্ষমতা? যদি উত্তর হ্যাঁ হয়। তাহলে এটাই স্পষ্টত শির্ক।
কেননা আল্লাহ্ ছাড়া পৃথিবীর কারো কোনো ক্ষমতা নেই যে, কোনো মানুষের উপকার, অপকার, বিপদে উদ্ধার, সন্তান প্রদান ইত্যাদি দেওয়ার বা করার ক্ষমতা আছে। সুতরাং যদি কেউ এমন ধারণা পোষণ করে যে আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোনো তাঁর বান্দার এইসব ক্ষমতা আছে, তাহলে তা আল্লাহর ক্ষমতার সাথে ঐ বান্দাকে শরীক করা হলো। আর এই শরীক করার সাথে সাথে যিনি শরীক করেন তিনি শির্কে জড়িয়ে পড়লেন।
কুরআনে “উছিলার” ব্যাখ্যাঃ
আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে বলেন,
“হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় কর, তাঁর নৈকট্য (ওয়াসিলা) অন্বেষন কর এবং তাঁর পথে জেহাদ কর যাতে তোমরা সফলকাম হও”। [ সুরা মায়েদা ৫:৩৫ ]
উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ্ জানিয়ে দিচ্ছেন যে, আল্লাহ্কে ভয় করতে হবে। এবং তাঁর সান্নিধ্য পেতে বা তাঁর নিকটে প্রিয় হতে উপায় অন্বেষণ করতে হবে। হতে পারে সেটা জিহাদ। যা দ্বারা তোমরা আল্লাহর কাছে প্রিয় হতে পারো এবং সফলকাম হতে পারো।
উপরোক্ত সহজ সরল আয়াতটিকে সুফিবাদী সুন্নীরা অপব্যাখ্যা করে। তারা তাদের ভক্ত মুরিদদের এটা প্রচার করে যে, এখানে যে উছিলার কথা বলা হয়েছে তা হচ্ছে “পীর “। অর্থাৎ উছিলা দ্বারা এখানে আল্লাহ্ পীরকেই বুঝিয়েছেন।
তাদের মতে এই আয়াতের অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর নৈকট্য লাভ পেতে হলে পীর ধরতে হবে। কেননা পীরই তাদেরকে হিদায়াত দিয়ে পথপ্রদর্শন করেন। সেইসাথে পীরের সুপারিশের নিয়ে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে।
অথচ সুফিদের এইসব আকিদা সম্পূর্ণ ভুল। কেননা রাসুল এবং সাহাবী তাবেয়ীদের জীবনী থেকে এটা প্রমাণিত নয় যে, এই আয়াতের উছিলার অর্থ পীর! শুধু কি তাই? রাসুল সাঃ পরবর্তী তিন চারশ বছর পরও পীর মুরিদ নিয়ে কোনো মতবাদ ছিলো না। এই সুফিবাদের পীর মুুরিদী সৃষ্টি হয়েছে ইসলাম প্রতিষ্ঠার তিন চারশ বছর পরে। সুতরাং সুফিরা এই আয়াতের যে অর্থ এবং ব্যাখ্যা দাঁড় করায় তা সম্পূর্ণ ইসলাম বিরোধী।
উপরোক্ত আয়াতে এই উছিলা অর্থ কী হতে পারে তার জবাব আল্লাহ্ নিজেই দিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ্ বলেন “তাঁর পথে জিহাদ করো। যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো “। আল্লাহ্ এখানে উছিলার কথা বলে কেন সফলতার জন্য জিহাদের কথা উল্লেখ করলেন?
তার জবাবে প্রত্যেক তাফসীরকারকরা একটি কথাই বলেছেন। আর তা হচ্ছে, এখানে উছিলা দ্বারা আল্লাহ্ তাঁর নৈকট্য লাভের বিভিন্ন উপায় উপকরণ কথাই বলেছেন। যা দ্বারা তাঁর বান্দারা তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে তাঁর নিকটবর্তী হতে পারে।
যদি সুফিদের মতে এখানে পীরের কথা আল্লাহ্ উল্লেখ করতেন। তাহলে সেই ব্যাখ্যা আমরা রাসুল এবং তাঁর পরবর্তীতে সাহাবীদের জীবনী থেকে শিক্ষা পেতাম। কিন্তু ইসলামের ইতিহাসে এমন কোনো কিছুরই নজির নেই।
বিখ্যাত সাহাবী এবং প্রথম সারির কুরআনের তাফসীরকারক হচ্ছেন “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস “। কুরআনের তাঁর বিখ্যাত তাফসীরে এই আয়াতের ব্যাখ্যায় এসেছে, উছিলা হচ্ছে আল্লাহ্কে ভয় করে তাঁর আদেশ নির্দেশ মেনে চলে তাঁর নৈকট্য লাভের উপায় অন্বেষণ করা। অপর ব্যাখ্যা হচ্ছে, বেশী বেশী নেক আমলের মাধ্যমে উচ্চ মর্যাদা অর্জন করে আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়া।
শুধু ইবনে আব্বাস নয়, পৃথিবীর সকল জগৎ বিখ্যাত তাফসীরকারকদের মতে এই আয়াতের উছিলার ব্যাখ্যা হচ্ছে সৎকর্ম। যার মাধ্যমে যেকোনো বান্দা তাঁর নৈকট্য লাভ করে নিকটবর্তী হতে পারে। সুতরাং এটা সুস্পষ্ট প্রমাণিত যে, উছিলার অর্থ কখনোই সুফিদের পীর নয়।
হাদিসের আলোকে উছিলাঃ
পবিত্র হাদীস শরীফে উছিলা বলতে যে কর্ম বা আমল বুঝানো হয়েছে, তার স্বপক্ষে কয়েকটি হাদীস রয়েছে।
আদী ইবনু হাতিম (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছিঃ
“তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি জাহান্নামের আগুন থেকে বেঁচে থাকার সামর্থ্য রাখে সে যেন একটা খেজুর দিয়ে হলেও তাই করে। (অর্থাৎ দান যতই ক্ষুদ্র হোক তাঁকে খাটো করে দেখা যাবে না। সামান্য দানও কবূল হলে নাযাতের ওয়াসীলাহ্ হতে পারে)। (সহীহ্ মুসলিম যাকাত অধ্যায় ২২৩৭ নং হাদীস, ই.ফা. ২২১৬)
ইবনু ‘উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃতিনি রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) থেকে বর্ণনা করেন যে,
“তিনজন লোক হেঁটে চলছিল। তাদের উপর বৃষ্টি শুরু হলে তারা এক পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নেয়। এমন সময় পাহাড় হতে একটি পাথর তাদের গুহার মুখের উপর গড়িয়ে পড়ে এবং মুখ বন্ধ করে ফেলে। তাদের একজন অন্যদের বললোঃ তোমরা তোমাদের কৃত ‘আমালের প্রতি লক্ষ্য করো যে নেক ‘আমাল তোমরা আল্লাহর জন্য করেছ; তার ওয়াসীলাহ্য় আল্লাহর নিকট দু’আ করো। হয়তো তিনি এটি হটিয়ে দেবেন। (এরপর তারা তাদের নেক আমলের ওয়াসীলাহ্ দিয়ে সেই বিপদ থেকে উদ্ধার হন। সংক্ষেপিত) (সহীহ্ বুখারী, আচার -ব্যবহার -৫৯৭৪, আধুনিক- ৫৫৪১, ই ফা -৫৪৩৬)
এইসব সহীহ্ হাদীস দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণিত যে, ওয়াসীলাহ্ হবে বান্দার নেক আমল। যা শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা হয়।
ওয়াসীলাহ্ দ্বারা জান্নাতের একটি স্থানের নামও এসেছে হাদীস শরীফে।
আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ
“আমার জন্য তোমরা আল্লাহ তা’আলার কাছে ওয়াসীলাহ্ কামনা কর। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! ওয়াসীলাহ্ কি? তিনি বললেনঃ জান্নাতের সবচাইতে উঁচু স্তর। শুধুমাত্র এক লোকই তা অর্জন করবে। আশা করি আমিই হব সেই ব্যক্তি। মিশকাত (৫৭৬৭), মুসলিম (২/৪) ।
আবদুল্লাহ ইবনু ‘আমর ইবনুল ‘আস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি নাবী(সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছেনঃ
” তোমরা যখন মুওয়াযযিনকে আযান দিতে শুন, তখন সে যা বলে তোমরা তাই বল। অতঃপর আমার উপর দুরূদ পাঠ কর। কেননা, যে ব্যক্তি আমার ওপর একবার দরূদ পাঠ করে আল্লাহ তা’আলা এর বিনিময়ে তার উপর দশবার রহমাত বর্ষণ করেন। অতঃপর আমার জন্যে আল্লাহর কাছে ওয়াসীলাহ্ প্রার্থনা কর। কেননা, ‘ওয়াসীলাহ্’ জান্নাতের একটি সম্মানজনক স্থান। এটা আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে একজনকেই দেয়া হবে। আমি আশা করি, আমিই হব সে বান্দা। যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে আমার জন্যে ওয়াসীলাহ্ প্রার্থনা করবে তার জন্যে (আমার) শাফা’আত ওয়াজিব হয়ে যাবে।(সহীহ্ মুসলিম -৭৩৫, ই. ফা. ৭৩৩ )[অনুরূপ হাদীস এসেছে, জামে’ আত-তিরমিজি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর সাহাবীগণের মর্যাদা – ৩৬১২, ৩৬১৪, মিশকাত -৫৭৬৭]
এইসব সহীহ্ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে ওয়াসীলাহ্ জান্নাতের একটি উঁচু মর্যাদাশীল একটি স্থান। যা কথা আমরা প্রতিনিয়ত আযানের দোয়ায় বলে থাকি। সুতরাং এটাও সঠিক যে ওয়াসীলাহ্ জান্নাতের একটি মর্যাদাশীল স্থান।
পবিত্র হাদীসে ওয়াসীলাহ্ দ্বারা জীবিত ব্যক্তিকেও বুঝানো হয়েছে।
পবিত্র হাদীসে ওয়াসীলাহ্ দ্বারা জীবিত ব্যক্তিকেও বুঝানো হয়েছে। যা আমরা ইতিমধ্যে আলোচনা করেছি।
আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ ‘উমার (রাঃ) অনাবৃষ্টির কারণে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে ‘আব্বাস ইবনু ‘আবদুল মুত্তালিব (রাঃ)-এর ওয়াসীলাহ নিয়ে বৃষ্টি বর্ষণের দু’আ করতেন। তিনি বলতেন, হে আল্লাহ্! আমরা অনাবৃষ্টি দেখা দিলে আমাদের নবীর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ওয়াসীলাহ নিয়ে দু’আ করতাম, তুমি বৃষ্টি বর্ষণ করতে; এখন আমরা আমাদের নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর চাচা ‘আব্বাস (রাঃ)-এর ওয়াসীলাহ্য় বৃষ্টি বর্ষণের দু’আ করছি। তুমি আমাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ কর। তখন বৃষ্টি হত। [সহীহ্ বুখারী সাহাবীদের মর্যাদা -৩৭১০আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩৪৩৫, ইসলামী ফাউন্ডেশনঃ ৩৪৪২ ] অনুরূপ হাদীস এসেছে সহিহ বুখারী বৃষ্টির জন্য দোয়া ১০১০ নং হাদীসেও।
সুতরাং এখানে দেখা যাচ্ছে যে, আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের নাম দিয়ে ওয়াসীলাহ্ করলে আল্লাহ সেই দোয়া কবুল করেন। এইসব হাদীসে খুবই স্পষ্ট যে জীবিত নেককার আল্লাহর বান্দা দ্বারা ওয়াসীলাহ্ চাওয়া হয়েছে। এমনকি রাসুল (সাঃ) কে দিয়েও নয়।
সুতরাং জীবিত যেকোনো আল্লাহর অলির কাছে গিয়ে নিজের যেকোনো প্রয়োজনের জন্য দোয়া চাওয়া যাবে। এবং তাঁকে ওয়সীলাহ্ করে দোয়া বা সাহায্য চাওয়াও যাবে।
পীরের উছিলায় সুপারিশ নয়ঃ
সুফি সুন্নীদের আকিদা হচ্ছে, উছিলা অর্থ পীর। তাই তারা পীরের মুরিদ হয়ে সুফিদের অনুসরণে ইসলাম পালন করে। তাদের বিশ্বাস পীরের উছিলায় পীরের সুপারিশে তারা আল্লাহর আযাব থেকে রক্ষা পেয়ে জান্নাতে চলে যাবে। এইসব পীরেরা ততক্ষণ পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করবেন না যতক্ষণ না তারা তাদের মুরিদদের জান্নাতে নিয়ে যেতে পারছেন!
তাদের এই বিশ্বাসের জবাব আল্লাহ্ অনেক আগেই কুরআনে দিয়ে দিয়েছেন। সুফি সুন্নীরা পীর ধরে আল্লাহর কাছে তাদের জন্য সুপারিশ করার জন্য। যা করতো মক্কার মুশরিকরা। মক্কার মুশরিকরাও আল্লাহ্কে স্বীকার করতো এবং বিশ্বাস করতো। তাদের যখন জিজ্ঞাসা করা হয় কেন তোমরা দেবদেবী অলি আউলিয়াদের পূজা করো? তখন তারা বলে,
” আর (মুশরিকরা) উপাসনা করে আল্লাহকে বাদ দিয়ে এমন বস্তুর, যা না তাদের কোন ক্ষতিসাধন করতে পারে, না লাভ এবং (তারা) বলে, এরা তো (দেবদেবী, অলি, আউলিয়ারা) আল্লাহর কাছে আমাদের সুপারিশকারী “। (সূরাঃ ইউনুস, আয়াতঃ ১৮)
ঠিক একইভাবে সুফি সুন্নীরাও পীর ধরে আল্লাহর কাছে তাদের জন্য সুপারিশ করার জন্য। অথচ আল্লাহ্ বলেন,
“যাদেরকে (দেবদেবী, পীর, আউলিয়া) তারা আহবান করে, তারা নিজেরাই তো তাদের পালনকর্তার নৈকট্য লাভের জন্য মধ্যস্থ ( উছিলা তথা উপায়) তালাশ করে যে, তাদের মধ্যে কে নৈকট্যশীল। তারা তাঁর রহমতের আশা করে এবং তাঁর শাস্তিকে ভয় করে। নিশ্চয় আপনার পালনকর্তার শাস্তি ভয়াবহ।”(সূরাঃ বনী ইসরাঈল, আয়াতঃ ৫৭)
যারা নিজেদের আল্লাহ্ থেকে রক্ষা করার জন্য ব্যক্তি পীর আউলিয়াকে উছিলা মনে করে, আল্লাহ্ বলেন তারা (অর্থাৎ ঐসব পীর আউলিয়ারা) নিজেরাই আল্লাহর কাছে উছিলা তথা সৎকাজের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করে।
অতএব সুফিদের উছিলা আর কুরআনের উছিলা কখনোই এক নয়। সুফিবাদ যে একটি কুরআন সুন্নাহ বিরোধী আকিদা তা এ থেকেই সুস্পষ্ট প্রমাণিত। সুতরাং উছিলা দ্বারা কখনোই পীর অলি আউলিয়া বা ব্যক্তি নয়।
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
অলংকার, চট্টগ্রাম।